রাজধানীর তেজগাঁওয়ে অবস্থিত রয়েল ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা সাবেক আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্য এইচবিএম ইকবালের উদ্যোগে ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। দীর্ঘ দুই দশক পেরিয়ে গেলেও বিশ্ববিদ্যালয়টি আজ পর্যন্ত কোনো সমাবর্তন অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পারেনি। এ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে রয়েছে অসংখ্য জালিয়াতি ও অনিয়মের অভিযোগ।
স্বৈরাচারের প্রভাব
৫ আগস্ট রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর দেশের অনেক প্রতিষ্ঠান পরিবর্তিত হলেও রয়েল ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা এখনও স্বৈরাচারী প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেনি। আমাদের তদন্তে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থী এবং কিছু শিক্ষক-কর্মকর্তার বক্তব্যে উঠে এসেছে, বিশ্ববিদ্যালয়টি ধীরে ধীরে “স্বৈরাচারের শেষ আশ্রয়স্থল”–এ পরিণত হয়েছে।
দিপু সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে অভিযোগ
শিক্ষা বিভাগের শিক্ষক দিপু সিদ্দিকীকে ঘিরে রয়েছে নানা বিতর্ক। তিনি সাংবাদিক পরিচয়ে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং আমেরিকায় পলাতক এক নেতার প্রতিষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু কমিশনের সদস্য হিসেবেও যুক্ত ছিলেন। সাবেক ভিসি ড. কলিমুল্লাহর ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে তিনি নিয়োগ বাণিজ্যে ভূমিকা রাখতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবসম্পদ বিভাগে তার কোনো নথি নেই। অভিযোগ রয়েছে, তিনি দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও মাস্টার্সের ভুয়া সার্টিফিকেট সংগ্রহ করেছেন। ৫ আগস্টের পর নিজেকে ‘ডক্টরেট’ পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত করে পূর্ণকালীন শিক্ষক এবং পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরের দায়িত্ব নিজের দখলে নিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের দাবি, তিনি জাল সনদ ইস্যু করেন এবং সার্টিফিকেট ভেরিফিকেশনও নিজের ক্ষমতায় পরিচালনা করেন।
অনেক শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, আন্দোলনে অংশ নেওয়ার কারণে তাদের সনদ আটকে দেওয়া হয়েছে। এমনকি তাদের হুমকি দিয়ে বলা হয়েছে—“দুই বছরের মধ্যে শেখ হাসিনা ফিরে আসবেন, তখন পরিস্থিতি বুঝতে হবে।” এছাড়া তার বিরুদ্ধে টাকা নিয়ে ভুয়া কেস ও মামলা করার হুমকি দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে।
উবায়দুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ
ব্যবসা প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক উবায়দুর রহমান ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাবেক নেতা। জুলাই আন্দোলনে তিনি সরাসরি শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এবং সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট মুছে ফেলতে শিক্ষার্থীদের চাপ দেন। অভিযোগ আছে, তিনি আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের “লাল বানর” বলে অপমান করেছেন।
৫ আগস্টের আগে তিনি লেকচারার থাকলেও পরবর্তীতে দ্রুত সহকারী অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। তার বিরুদ্ধেও অতীতে রাজনৈতিক সহিংসতা ও একটি চুরির মামলা রয়েছে। বর্তমানে তিনি ঢাকার নতুন বাজার এলাকায় বসবাস করছেন।
অভিযোগিত বাণিজ্যিক কার্যক্রম
অভিযোগ রয়েছে, দিপু সিদ্দিকী ও উবায়দুর রহমান ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মীর কাছ থেকে এক থেকে দুই হাজার টাকা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুয়া আইডি কার্ড সরবরাহ করেছেন। ফলে তারা ঢাকায় নির্বিঘ্নে চলাফেরা করতে পারছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের মিছিলের প্রস্তুতিতেও তাদের সক্রিয় থাকতে দেখা গেছে।
সনদ বাণিজ্য নিয়ে তদন্ত
গত এপ্রিল মাসে সার্টিফিকেট বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠার পর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এতে দেখা যায়, মাত্র ছয় মাসে প্রায় ৪০০ ভুয়া শিক্ষার্থী আইডি তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটি আইডির বিনিময়ে ১.৫ থেকে ২ লাখ টাকা নেওয়া হয়, যা থেকে প্রায় পাঁচ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে।
তদন্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক আইটি প্রধান ফেরদৌস ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার মুশফিকুর রহমানের সম্পৃক্ততা প্রমাণিত হয়। তবে তাদের চাকরি থেকে অব্যাহতি দিলেও কোনো আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বরং আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি। অভিযোগ রয়েছে, চাকরি হারানোর পরপরই তারা নতুন সম্পদ ও গাড়ি ক্রয় করেছেন।
এক শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, নিজের আইডি দিয়ে লগইন করলে তিনি দেখতে পান, তার তথ্যের জায়গায় অন্য একজনের ছবি ও নাম যুক্ত করা হয়েছে।
ইউজিসি’র অবস্থান
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, রয়েল ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা নিয়ে ইতোমধ্যেই তাদের কাছে বহু অভিযোগ এসেছে। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
উপসংহার
শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের অভিযোগ, সার্টিফিকেট বাণিজ্য, রাজনৈতিক প্রভাব এবং অনিয়মের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়টি শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। এখন প্রশ্ন থেকে যায়—কর্তৃপক্ষ কার্যকর ব্যবস্থা নেবে, নাকি প্রতিষ্ঠানটি অনিয়মের রাজত্ব হিসেবেই থেকে যাবে?









